eng
competition

Text Practice Mode

লখার একুশ

created Mar 26th 2022, 17:37 by rakib713481


1


Rating

610 words
7 completed
00:00
লখার রাতের বিছানা ফুটপাতের কঠিন শান। এই শান দিনের বেলায় রোদে পুড়ে গরম হয়। রাতে হিম লেগে বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়। ঠাণ্ডা শানে শুয়ে লখার বুকে কাশি বসে। গায়ে জ্বর ‍ওঠে।
বাপকে লখা দেখেনি। চেনে না। মা তার ত্যানাখানি পরে দিনভর কেঁদে-কেঁদে ভিখ মেঙে ফেরে। লখার দিন কাটে গুলি খেলে, ছেঁড়া কাগজ কুড়িয়ে, বন্ধুদের সঙ্গে মারামারি করে আর খাবারের দোকানের এঁটোপাতা চেটে। রাতে মায়ের পাশে লখা খিদের কষ্ট ভুলে যায়।
এই লখা, ছায়া দেখলে বুক কেঁপে যার, সে আজ ভোররাতে মায়ের পাশ থেকে উঠে পড়ল। মা মুখ হাঁ করে ঘুমুচ্ছে। লখা চুপি চুপি পা ফেলে হারিয়ে গেল ধোঁয়-ধোঁয়া কুয়াশার মধ্যে।
খানিকটা এগিয়ে উঁচু রেলরাইন যেন দুটো মরা সাপ। পাশাপাশি শুয়ে আছে চুপচাপ। লখা ইটের টুকরো দিয়ে ইস্পাতের লাইনে ঠুক-ঠুক ঠুকে তার উপর কান পাতল। হ্যাঁ, শব্দ শোনা যাচ্ছে। যেন গানের সরলহারি বয়ে যাচ্ছে কানের ভিতর দিয়ে। লখা ভারি মজার দুষ্টু ছেলে। গানের মজা ফুরিয়ে গেলে পর এক লাফে লাইন পেরিয়ে ওপারে পৌছে গেল। সেখানে মস্ত নিচু খাদ। তার ভিতর গড়িয়ে পড়লে হাত-পা ভাঙবে নির্ঘাত। খুব সাবধানে খাদ পেরিয়ে ওপারের ডাঙায় উঠে এলো সে। ডাঙাটা আসলে বনজঙ্গলে অন্ধকার। ঝিঁঝি পোকা ডাকছে আর ধেড়ে ধেড়ে গাছের ঝাঁকড়া ছায়া মাথা নেড়ে নেড়ে ভয় দেখাচ্ছে লখাকে।
খচ করে কাঁটা ঢুকে গেল বাঁ পায়ে। কীসের কাঁটা? হবে হয়তো বাবলা-টবলার। লখা উবু হয়ে বসে কাঁটাটা খসিয়ে দূরে ছুড়ে ফেলে দিলো। কিন্তু অসহ্র যন্ত্রণা! আঁ আঁ বলে কেঁদে দিলো লখা। কিন্তু কাঁদলো তো চলবে না। সময় নেই আর। তাকে যে যেতেই হবে। আবছা অন্ধকারে। ফিনফিনে ঠাণ্ডা। গাছের পাতা বেয়ে শিশির গড়িয়ে পড়ছে। খুক খুক করে কাশি আসছে লখার। খালি গা শিশিরে ভিজে শীত লাগছে। একটা হ্যাঁচড়া ডাল লখার হাফপ্যান্টটা টেনে ধরেছে পিছন দিক দিয়ে। প্যান্ট আধখসা অবস্থায় দৌড়াতে লাগল সে।
একটা খেঁকশেয়াল বুঝি তাকিয়ে দিখছিল তাকে। দেখুখ গে। এখন ভয় ভয় করলে দেরি হয়ে যাবে। কাজেই এবার চোখ-কান বুজে দৌড় শুরু করতে হলো তাকে। আর শেষটায় সেই অদ্ভুত গাছটার নিচে পোঁছে গেল লখা, যার ডালে ডালে রক্তের মতো টুকটুকে লাল ফুল। দিনের বেলায় রেললাইনের উপর দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে থোকা থোকা ফুলের লাল ঝুঁটির পানে তাকিয়ে থাকে সে। এখন ওই উপরের এক থোকা ফুল তার পেড়ে আনা চাই।
হাতের মুফো পাকিয়ে মনটাকে শক্ত করে নিল লখা। তারপর চড় চড় করে গাছে উঠে গেল। একবারে কাঠবেড়ালির বাচ্চা যেন। মগডালের কাছাকাছি এসে কয়েকটা তুলোমিঠের মতো বড় বড় থোকা পেয়ে গেল সে। শিশিরে ভেজা তুলতুলে। তা হোক, তোমরা এখন আমার। নাও সব টুপটাপ নেমে এসো তো আমার মুঠোর মধ্যে। কষ্ট লাগছে। আহা! কীসের কষ্ট? এই তো একটু পরে আমি তোমাদের এমন একটা উঁচু জায়গায় রেখে দেবো, যেখানে অবধি তোমরা এই গাছের মগডালে কোনোদিন উঠতে পারবে না। এসো, এসো লক্ষ্মীসোনারা সব নেমে এসো তো।
ফুল নিয়ে যখন মাটিতে নেমে এলো লখা, তখন সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে  তার। কনুই বুকে চটচটে ঠাণ্ডা। হাত দিয়ে টের পায়, টাটকা রক্ত। গাছের ডালপালা কাঁটায় ভর্তি। গা-হাত-পা ছিঁড়ে গেছে আঁচড় লেগে। তাতে কী! জিতে গেছি আমি। গর্বে বুক ফুলে ওঠে লখার।
সেদিন সকাল ছিল বড় আশ্চর্য সুন্দর। আকাশে হালকা কুয়াশা। অল্প অল্প শীত। আর দক্ষিণের সামান্র বাতাস। পথে পথে মিছিলের ঢল নেমেছে। শত শত মানুষ। হাতে ফুলের গুচ্ছ। ঠোঁটে প্রভাতফেরির গান। ধীর পায়ে শহিদ মিনারের দিকে এগিয়ে চলেছে। এই ভিড়ের মধ্যে ক্ষুদে টোকাই লখাকে টিকই দেখা যাচ্ছে। তাকে চিনতে কষ্ট হয় না। কারণ মিছিলের সবার গায়ে চাদর, কোট, সোয়েটার। শুধু তার গা খোলা উদাম গাঢ় কালো। হাত উপচে পড়ছে রক্তলাল ফুলের গুচ্ছ। মিছিলে পা মিলিয়ে সেও চলেছে শহিদ মিনারে ফুল দিতে। সবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে গেয়ে চলছে - আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি? কিন্তু তার গলা দিয়ে কথা তো ফোটে না, শুধু শব্দ হয় আঁ আঁ আঁ আঁ
আসলে কথা ফুটবে কী করে! লখা যে জন্মবোবা। বাংলা বুলি তার মুখে ফুটতে পায় না। সে মনে মনে বলে - বাইরে শব্দ হয় আঁ আঁ আঁ আঁ।

saving score / loading statistics ...