eng
competition

Text Practice Mode

অসীম বুদ্ধিমত্তা কতটুকু প্রয়োজন? {প্রথম আলো, আরাফাত রহমান (যুক্তরাষ্ট্র)}

created Jul 14th 2021, 13:45 by Asfar Uddin


2


Rating

945 words
4 completed
00:00
আমরা যখন স্কুলে ভর্তি হই, অঙ্ক করতে শিখি, ছোট ছোট যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগে অভ্যস্ত হই, তখন শিক্ষকেরা বড় বড় সংখ্যার যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ করতে শেখান। এরপর আসে সরল। সরল সমাধানে অভ্যস্ত হতে না হতেই আসে ঐকিক নিয়ম। এভাবে গণিত কঠিন থেকে ক্রমে কঠিনতর হতেই থাকে। গণিতের নতুন পদ্ধতি আয়ত্ত করার সময় দেখা যায়, কেউ কেউ খুব সহজেই নিয়মগুলো শিখে ফেলেছে। অন্যরা যখন বারবার একই ভুল করছে, তখন তারা অনায়াসেই নতুন পদ্ধতি আয়ত্ত করে ফেলেছে। শুধু স্কুলে অঙ্ক করার সময় নয়, যেকোনো কিছু শেখার ক্ষেত্রে শিক্ষানবিশের তুলনামূলক দ্রুতি বা ধীরগতি চোখে পড়ে। দেখা যায়, ক্রিকেট খেলার সময় কেউ সহজেই ব্যাট পরিচালনা করা শিখে ফেলছে, কেউবা বাদ্যযন্ত্র থেকে সুর বের করে ফেলছে বিনা পরিশ্রমে, কেউ হয়তো প্রোগ্রামিংয়ের মূলনীতিগুলো ধরে ফেলছে দ্রুতগতিতে। কিন্তু যে ছেলে বা মেয়ে খুব দ্রুত শিখে ফেলছে, সে কি পরবর্তী জীবনেও সাফল্যের শীর্ষে থাকবে? আসলে শিক্ষানবিশ থেকে সুনিপুণ, অভিজ্ঞ কিংবা পারদর্শী হওয়ার যাত্রা সরলরৈখিক নয়। শেখার একেক পর্যায়ে একই মানুষের গতি ভিন্ন হতে পারে। মনোবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, একটা নির্দিষ্ট সীমার পর উচ্চবুদ্ধিমত্তা সাফল্য অর্জনে তেমন একটা কাজে লাগে না। লুইস টারমান গবেষণা তেমনটাই বলে।
বুদ্ধিমান টারমাইটস
গত শতাব্দীর শুরুর দিকে ধারণা ছিল, শিশুরা ছোটবেলায় বেশি পড়াশোনা করলে অকালপক্ব হয়। ছোটবেলাতেই বেশি বুঝে ফেলায় তারা প্রাপ্ত বয়সে খুব দ্রুত ঝরে পড়ে। পূর্ণ বয়সে তারা আর ভালো করতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক লুইস টারমান এটা মানতেন না। তাই ১৯২১ সালে তিনি গবেষণা শুরু করেন। ক্যালিফোর্নিয়ার প্রাথমিক স্তরের অনেক বিদ্যালয়ের সেরা ছাত্রদের বাছাই করা হলো তাঁর গবেষণার জন্য। আইকিউয়ের ভিত্তিতে তাদের মধ্য থেকে সেরা ১০ শতাংশ বাছাই করা হলো। আবার তাদের বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষা করা হলো। যাদের আইকিউ ১৩০-এর ওপরে, তাদের নিয়ে আবারও আরেকটা পরীক্ষা করা হলো। এভাবে টারমান আড়াই লাখ স্কুলছাত্র থেকে প্রায় দেড় হাজার (১ হাজার ৪৭০) শিক্ষার্থী বেছে নিলেন। এরা ছিল সেরাদের সেরা। এদের আইকিউ ছিল ১৪০ থেকে ২০০ পর্যন্ত! এই শিশু-প্রতিভাদের নাম দেওয়া হলো টারমাইটস।লুইস টারমান সারা জীবন এই টারমাইটদের অনুসরণ করে গেছেন। এদের বিভিন্ন সময়ে পরীক্ষা করা হতো, মাপা হতো, বিশ্লেষণ করা হতো। তাদের শিক্ষাগত অর্জন, বিয়ে, অসুস্থতা, মানসিক স্বাস্থ্য আর যাবতীয় পদোন্নতি কিংবা চাকরির পরিবর্তন নথিবদ্ধ করা হতো। টারমাইটরা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টারমান এদের ওপর করা বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা শুরু করলেন। ক্যালিফোর্নিয়ার বিভিন্ন প্রতিযোগিতার শীর্ষ তালিকায় প্রায়ই টারমাইটদের নাম খুঁজে পাওয়া যেত। টারমান মনে করতেন, টারমাইটরাই হবে আমেরিকার ভবিষ্যৎ অভিজাত। ধরা হতো, টারমাইটদের (অন্য কথায় উচ্চবুদ্ধিসম্পন্ন) সাফল্য সুনিশ্চিত। কিন্তু আসলেই কি তা-ই হলো?
টারমাইটরা পূর্ণ বয়সে পৌঁছানোর পর লুইস টারমানের ভাবী কথনে ভুল বের হতে শুরু করল। কোনো কোনো টারমাইটস লেখক গবেষক হলেন। কেউ হলেন ভালো ব্যবসায়ী। অনেকেই সরকারি চাকরি করতেন। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন ভালো বিচারক ছিলেন। কিন্তু এই প্রতিভাধরদের মধ্যে খুব অল্প কয়েকজন জাতীয় ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হতে পারলেন। টারমাইটদের উপার্জন গড়পড়তা ভালোই ছিল; কিন্তু অত ভালো না! এই টারমাইটদের মধ্যে কেউ নোবেল পুরস্কার পায়নি, বরং টারমানের শিশুপ্রতিভা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় দুজন নোবেলজয়ী বাদ পড়ে গিয়েছিলেন! পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত উইলিয়াম শোকলে এবং লুইস অ্যালভারেজের আইকিউ টারমাইটদের দলভুক্ত হওয়ার জন্য যথেষ্ট বেশি ছিল না।
লুইস টারমানের ভুল
 
টারমাইট গবেষণার অদ্ভুত ফলাফলের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় সাম্প্রতিক একটি গবেষণা থেকে। ২০০৬ সালে তিন ব্রিটিশবিজ্ঞানী মেরিম বাইলালিক, পিটার ম্যাকলিয়ড ফারন্যান্ড গবেট একটি উল্লেখযোগ্য পরীক্ষা করেন। তাঁরা ৫৭ জন তরুণ দাবা শিক্ষানবিশ নিয়ে গবেষণাটা করেন। এই দলটি ছিল থেকে ১৩ বছর বয়স্ক স্কুলপড়ুয়াদের নিয়ে। এদের একেকজন গড়ে বছর ধরে দাবা খেলার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এদের মধ্যে অনেকেই খেলায় খুব কুশলী ছিল। আবার অনেকেই ছিল যাদের দক্ষতা উল্লেখযোগ্য নয়। গবেষণার লক্ষ্য ছিল কেউ দাবা খেলায় দক্ষ হয়ে উঠবে কি না, তার ওপর বুদ্ধিমত্তার প্রভাব অনুসন্ধান।
 
গবেষকেরা এই ৫৭ জন শিক্ষানবিশ দাবাড়ুর আইকিউসহ ধীশক্তি-সম্পর্কিত বিভিন্ন দক্ষতা মাপেন। তাঁরা দলটিকে ছয় মাস ধরে ডায়েরি রাখতে বলেন। ডায়েরিতে দৈনিক অনুশীলন সময় লিপিবদ্ধ করবে শিক্ষানবিশরা। এদের দাবার দক্ষতা মাপতে গবেষকেরা তাঁদের বিভিন্ন দাবার ধাঁধা সমাধান করতে দিতেন।
 
গবেষণার যাবতীয় উপাত্ত হাতে আসার পর দেখা গেল, ভালো দাবা খেলার জন্য সবচেয়ে বড় প্রভাব রেখেছে দাবাড়ুর অনুশীলনের পেছনে ব্যয় করা সময়। বুদ্ধিমত্তা বড় ভূমিকা না রাখলেও এর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব লক্ষণীয়। উচ্চতর আইকিউর সঙ্গে দাবা খেলায় ভালো দক্ষতার সম্পর্ক বোধগম্য। ফলাফল থেকে গবেষকেরা উপসংহার টানেন যে দাবা খেলায় দক্ষতার ক্ষেত্রে অনুশীলনের পেছনে দেওয়া সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিমত্তাও একটি ভূমিকা রাখে।
 
তবে চিত্রটি আমূল বদলে যায় যখন গবেষকেরা এই দলের মধ্যকার ২৩ জনের ওপর পরীক্ষাটি করেন। উপদলটি ছিল সেরাদেরও সেরা। এই সেরা দাবাড়ু দলটির গড় রেটিং ছিল দেড় হাজার। তারা প্রায়ই বিভিন্ন জাতীয় আন্তর্জাতিক দাবা প্রতিযোগিতায় অংশ নিত। এদের ক্ষেত্রেও দেখা গেল অনুশীলনের পেছনে দেওয়া সময় সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী ভূমিকা রাখছে। অন্যদিকে বুদ্ধিমত্তার কোনো ভূমিকাই নেই। বরং এই সেরা দলটির মধ্যেও যারা তুলনামূলক ভালো খেলে, তাদের আইকিউ দলের অন্যদের তুলনায় কিছুটা কম!
 
বিষয়টা হজম করার জন্য কিছু সময় নেওয়া যাক। এই সেরা উপদলের মধ্যে উচ্চ আইকিউ কোনো বিশেষ সুবিধা নয়, বরং কিঞ্চিত অসুবিধাই বটে। গবেষকেরা কারণ খুঁজে বললেন, সেরা দাবাড়ু যাদের আইকিউ কম, তাদের মধ্যে অনুশীলন করার ঝোঁকটা বেশি। যে কারণে তারা এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে যে বেশি আইকিউসম্পন্ন সেরা দাবাড়ুদের চেয়েও তারা ভালো করছে।
এই ফলাফল আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শুধু দাবা নয়, বরং যেকোনো দক্ষতার ক্ষেত্রে বুদ্ধিমত্তার চেয়ে অনুশীলন দরকারি। উচ্চবুদ্ধিমত্তা শেখার ক্ষেত্রে শুরুর দিকে এগিয়ে রাখে। তবে সুবিধা শেখার একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত কাজ করে। বিশেষ করে নিয়ম শেখা স্মরণ করা পর্যন্ত। উচ্চবুদ্ধিমত্তা বিভিন্ন নিয়মকানুনের মধ্যকার সম্পর্ক সাজাতে পরিকল্পনা করতে সাহায্য করে। কিন্তু একপর্যায়ে অনুশীলন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুশীলনের মাধ্যমে বিভিন্ন নিয়ম এদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের বিভিন্ন জটিল ধাঁচ এমনভাবে পরিচিত হয়ে যায় যে আর সচেতনভাবে চিন্তা করতে হয় না। অনেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই অনুশীলনকারী যেকোনো সমস্যার সমাধানে কোন পথে হাঁটতে হবে, সেই অন্তর্দৃষ্টি লাভ করে। বুদ্ধিদীপ্তভাবে বিভিন্ন উপাত্ত নিয়মের মধ্যকার আন্তসম্পর্ক খুঁজে বের করার চেয়ে এই অন্তর্দৃষ্টি নিমেষেই কাজ করতে পারে। তখন অনুশীলনকারী আর শিক্ষানবিশ থাকে না, হয়ে পড়ে সেরাদের সেরা। জন্যই হয়তো ইংরেজিতে বলা হয়, ‘when talent doesn’t work, hard work beats talent!’
 
লেখক: পিএইচডি গবেষক, রিভারসাইড কলেজ, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র
 
সূত্র: সাইকোলজিটুডে ডট কম
 
*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত

saving score / loading statistics ...